নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: বিগত ৬১ বছরের রেকর্ড ভেঙে চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয়েছে দেদার। ভোক্তা ও শিল্পখাতে চাহিদার বিপরীতে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি এবার লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন। এখনো চাষিদের প্রচুর লবণ মজুদ রয়েছে মাঠের গর্তে ও গুদামে। যা রহস্যজনক কারণে বিসিকের উৎপাদনের হিসাবে যোগ করা হয়নি।
অবশ্য চলতি মৌসুমে সরকার যে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, তা গেল বছরের চাইতে ৫ লাখ মেট্রিক টন বেশি। হঠাৎ করে বছরের ব্যবধানে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পেছনে রহস্য ছিল বলে লবণ চাষি ও ব্যবসায়ী অনেকের অভিমত। তবে এই ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী লবণ মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট কারো কারসাজি রয়েছে বলেও দাবি মাঠপর্যায়ের চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের লবণ ব্যবসায়ীদের অনেকে বলেন, বছরের ব্যবধানে এক লাফে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্য রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এর পেছনে লবণ মিল মালিকদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে হাত রয়েছে। তাই চলতি বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক লাফে ৫ লাখ মেট্রিক টন বাড়িয়ে ২৩ দশমিক ৩৫ লাখ মেট্রিক টন করা হয়েছে।
তারা আরো বলেন, চলতি বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনে অন্যতম রহস্য হচ্ছে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানির জন্য। তাই সামনের কোরবানির ঈদে চামড়াজাত শিল্পে ব্যবহারের জন্য লবণ সংকট পড়েছে দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা শুরু করেছে সেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেটটি। এজন্য কিছু কিছু গণমাধ্যমে লবণ সংকটের হাইপ তোলা হচ্ছে। যা মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই সরকারকে এই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখার জোর দাবি জানাচ্ছি।
তবে বছরের ব্যবধানে দেশে একলাফে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণের বাড়তি চাহিদা বেড়ে যাওয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তাই। তবে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রতিবছর ভোক্তা ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ঢাকাতেই। তাই এই বিষয়ে কঙবাজারের কারো হস্তক্ষেপ বা সমন্বয়ের কোনো সুযোগ অবারিত নেই।
বিসিকের কক্সবাজারের লবণ প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, সরকার চলতি মৌসুমে লবণের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ২৩.৩৫ লাখ টন। চাহিদাও রয়েছে এর প্রায় কাছাকাছি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন ৫ লাখ টন কম হলেও লবণের সংকট সৃষ্টির তেমন আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মৌলভী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, চলতি বছর আবহাওয়া অনুকূলে ছিল বেশ। তাই ব্যাপকহারে লবণ উৎপাদন হয়েছে একমাত্র উৎপাদনকারী অঞ্চল কঙবাজারে। তারা বলেন, সরকার কোন জরিপের ভিত্তিতে এইবার ভোক্তা ও শিল্পখাতে লবণের চাহিদা নিরূপন করেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। মাত্র বছরের ব্যবধানে দেশে এক লাফে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণের চাহিদা বেড়ে যাওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক। মূলত বিদেশ থেকে লবণ আমদানির অজুহাত খুঁজতেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চাহিদা বাড়িয়ে দেওয়ার এই কারসাজি করা হয়েছে। দুই লবণচাষি নেতা দাবি করেন, বর্তমানেও অনেক লবণ মাঠের গর্তে, গুদামে মজুদ রয়েছে। যা এবারের কোরবানির ঈদে চামড়াজাত করতেও ব্যবহার করা যাবে। কোনোভাবেই বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে হবে না। তবে ইতোমধ্যে সেই মধ্যস্বত্বভোগী মিল মালিক সিন্ডিকেট বিদেশ থেকে লবণ আমদানির জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যাতে দেশীয় লবণ শিল্প মার খায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) বলছে, লবণ চাষের জমি ও চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। এবার ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। এই পরিমাণ জমিতে চাষির সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ২৩১। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৮.২৪ লাখ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল।
সৌরতাপে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানিতে ১৯৬০ সাল থেকে কক্সবাজারে বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরু হয়। কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় লবণ চাষ হয়ে থাকে।
পাঠকের মতামত: